খালেদা জিয়া: বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ
খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে মহীয়সী এক নারী। নীতির প্রশ্নে দৃঢ়তা, গণমানুষের অধিকার আদায়ে আপসহীনতা, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে অবিচল, কথাবার্তায় শালীনতাবোধ, মার্জিত আচরণ, অনমনীয়তা এবং বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আত্মত্যাগের সংমিশ্রণে শক্তিশালী রাজনৈতিক চরিত্রের অধিকারী অনন্য নেত্রী তিনি। কর্মগুণে তিনি পরিণত হন বাংলাদেশের মানুষের ভরসাস্থলে।
দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে জননন্দিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির অত্যন্ত সফল চেয়ারপারসন। শত ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের মধ্যেও তিনি দলটির জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছেন। তিনি নিজেও পরিণত হয়েছেন মানুষের আস্থার প্রতীকে।
খালেদা জিয়া ১৯৯১ সাল থেকে তিনবার বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নির্বাচিত নারী সরকার প্রধান। তিনি ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনে প্রার্থী হয়ে সব কয়টি আসনে জয় পান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলোতেই বিজয়ী হন।
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট অবিভক্ত ভারতবর্ষের জলপাইগুঁড়ির ছোট্ট শহরে বেগম জিয়ার জন্ম। পৃথিবীতে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা থেমেছে মাত্র। তখন শরতের স্নিগ্ধ ভোর। নতুন ফুটফুটে শিশু কন্যার আগমনে পরিবারের সবাই আনন্দিত। নাম রাখা হয় ‘শান্তি’। পরে মেঝ বোন সেলিনা ইসলাম পুতুলের মতো শিশুর ডাক নাম রাখেন ‘পুতুল’। জলপাইগুঁড়ি থেকে পরবর্তী পর্যায়ে তার পরিবার দিনাজপুরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
১৯৬০ সালে তিনি দিনাজপুর সরকারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে লেখাপড়া করেন। কলেজে পড়ার সময় তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৬৫ সালে কলেজে ডিগ্রি কোর্সে অধ্যয়নকালে বেগম খালেদা জিয়া স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ দেশের স্বাধিকারকামী মানুষের ওপর নৃশংসরূপে ঝাঁপিয়ে পড়লে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এমনি পরিস্থিতিতে বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রামে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর ছোট্ট দুই ছেলেকে নিয়ে ১৬ মে নৌপথে ঢাকায় আসেন। বড় বোন খুরশীদ জাহান হকের বাসায় ২৭ জুন পর্যন্ত দুই সন্তানকে নিয়ে আত্মগোপন করেন তিনি।
২ জুলাই পাকিস্তানি সেনারা দুই ছেলেসহ তাকে বন্দি করে। দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকার পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে ১৯৮১ সালের ৩১ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান কিছু বিপদগামী সেনা সদস্যের হাতে শাহাদতবরণ করেন। ততদিন অবধি সাধারণ আটপৌরে গৃহবধূই ছিলেন তিনি।
শেষ অবধি দলের নেতাকর্মীদের দাবির টানে ঘরের চৌহদ্দি ডিঙ্গিয়ে তাকে নামতে হয় রাজপথে। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি দলের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেন খালেদা জিয়া। পরের বছরের মার্চে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন তিনি। ১৯৮৪ সালের ১০ মে খালেদা জিয়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপি চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
জিয়াউর রহমান বীর উত্তম যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন, তখন বেগম জিয়া ফার্স্ট লেডি হিসেবে তার সঙ্গী হিসেবে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এবং নেদারল্যান্ডের রানী জুলিয়ানাসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
১৯৮১ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের সবচেয়েব সফল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের পর, তিনি ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি সাধারণ সদস্য হিসাবে বিএনপিতে যোগদান করেন। তিনি ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে দলের ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৮৪ সালের আগস্টে দলটি তাকে চেয়ারপারসন নির্বাচিত করেন।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে বন্দুকের নল উঁচিয়ে ক্ষমতা দখল করলে বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি এরশাদের স্বৈরশাসন থেকে দেশ পুনরুদ্ধারে ১৯৮৩ সালে গঠিত সাত দলীয় জোট গঠনের স্থপতি ছিলেন। তিনি ১৯৮৬ সালে স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে প্রহসনের নির্বাচনের বিরোধিতা করেন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। যদিও আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মতো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা এরশাদের অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেয়ার জন্য জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন শাসনের অধীনে নির্বাচনে যোগ দিয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়া এক মুহূর্তের জন্যও স্বৈরাচারের সাথে আপস করেননি। এরশাদ ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য নির্বিচারে ছাত্র হত্যার পথ বেছে নেয়। তিনি এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। তার দৃঢ় সংকল্পে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতবার আটক করা হয় তাকে। এসময় দেশের জনগণ তাকে ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধি দেন।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন বেগম জিয়া। তার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার মেয়াদে বেশ কিছু অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। কর্মসংস্থানের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এই সময় এবং শুধুমাত্র তৈরি পোশাকশিল্প খাতেই পাঁচ বছরে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি ছিল ২৯%। প্রায় দুই লাখ নারী এই সময় তৈরি পোশাকশিল্প খাতে যোগ দেয়।
তিনি জাতিসংঘে গঙ্গার পানি-বণ্টনের সমস্যা উত্থাপন করেন, যাতে বাংলাদেশ গঙ্গার পানির ন্যায্য অংশ পায়। ১৯৯২ সালে তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হলে সেখানে তিনি রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের সমস্যা উত্থাপন করেন এবং পরে মিয়ানমার সরকার ১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি করে।
আপসহীন সংগ্রাম আর দেশজুড়ে বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে চট্টগ্রামের লালদিঘীর ময়দানে লাখো জনতার সমাবেশে বেগম খালেদা জিয়াকে ‘দেশনেত্রী’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সে সময় থেকে ‘দেশনেত্রী’ খালেদা জিয়ার নামের অংশ হয়ে যায়।
১৯৯৬ সালে বিএনপির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর খালেদা জিয়া টানা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পুনরায় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রতিশ্রুতির কারণে, তিনি এক মাসের মধ্যে পদত্যাগ করেন। ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে দেশি ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিএনপিকে হারিয়ে দেয়া হয়। তবে দলটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল হিসেবে ১১৬টি আসন পায় সেই নির্বাচনে।
বিএনপি ১৯৯৯ সালে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে চারদলীয় জোট গঠন করে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলে। বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হন। ফোর্বস ম্যাগাজিন নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে তার ভূমিকার জন্য ২০০৫ সালে বিশ্বের সেরা নারী ব্যক্তিত্বের তালিকায় তাকে ২৯ নম্বরে স্থান দেয়।
২০১১ সালের ২৪ মে নিউ জার্সি স্টেট সিনেটে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘ফাইটার ফর ডেমোক্রেসি’ পদক প্রদান করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট সিনেট কর্তৃক কোনো বিদেশিকে এ ধরনের সম্মান প্রদানের ঘটনা এটাই ছিল প্রথম। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই তাকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ সম্মাননা দেয় কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (সিএইচআরআইও) নামের একটি সংগঠন।
২০০৬ সালে, তিনি একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে, তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্বাসনে পাঠানোর একাধিক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দুর্নীতির তুচ্ছ এবং ভিত্তিহীন অভিযোগে স্বৈরাচারী সরকার গ্রেফতার করে।
ক্ষমতায় থাকাকালীন, খালেদা জিয়ার সরকার বাধ্যতামূলক বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা, মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা, ছাত্রীদের জন্য একটি শিক্ষা ‘উপবৃত্তি’ এবং শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য খাদ্য প্রবর্তন করে শিক্ষা ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি করেছিল। তার সরকার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করে এবং শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ করে।
২০০৯ সাল থেকে, যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নির্বিচারে গুম, খুন, ক্রসফায়ার আর বিনাবিচারে ভিন্নমতের রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র থেকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করে, তখন তিনি গণতন্ত্রের জন্য তার লড়াই নতুন করে শুরু করেছিলেন। সরকার তাকে জোরপূর্বক তার বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের করে দেয় এবং গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন শুরু করায় তাকে দুইবার গৃহবন্দী করা হয়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালে বেগম খালেদা জিয়াকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০২০ সালের কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস প্রতিবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট আন্তর্জাতিক এবং দেশিয় আইন বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে যে, মূলত নির্বাচনি প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য একটি রাজনৈতিক চক্রান্ত হিসেবেই তাকে সাজা দেয়া হয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে তার ‘ন্যায্য বিচারের অধিকারকে সম্মান করা হচ্ছে না।’
বাংলাদেশে বেগম খালেদা জিয়াই একমাত্র নেত্রী, যিনি অন্তত ১১ বার বন্দিদশা মোকাবিলা করে স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষুকে ভ্রুকুটি করে ষড়যন্ত্র ও কুটিলতার জাল ছিন্ন করে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উজ্জ্বল পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন এবং সফলকাম হয়েছিলেন।
খালেদা জিয়ার ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ওয়ান ইলেভেনের সময়। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির সেনানিয়ন্ত্রিত সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোসহ জিয়া পরিবারের ওপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতনের ভয়াবহতা। খালেদা জিয়াকে বন্দি করে সাব-জেলে নিক্ষেপ করা হয়। দেশত্যাগে বাধ্য করতে তার ওপর নানামুখী চাপ সৃষ্টি করা হয়। তারেক রহমানকে বন্দি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে বন্দি করা হয়। চলে নিপীড়ন। সুস্থ সবল আরাফাত রহমান জেল থেকে বের হন মুমূর্ষু অবস্থায়। এরপর আর একদিনের জন্যও সুস্থ হননি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তারেক রহমান জেলখানা থেকে বের হন ভাঙ্গা মেরুদণ্ড নিয়ে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় খালেদা জিয়া-তারেক রহমান ও বিএনপি বিনাশের নীলনকশা। তারই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনার বিতর্কিত আদালত কথিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম জিয়াকে কারাবন্দি করেন। সেই থেকে শুরু হয় তার জেলজীবন। জেলে তাকে বিনা চিকিৎসায় জীবননাশের উপক্রম করা হয়। প্রায় দুই বছর পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের সময় পারিবারিক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ছয় মাসের জন্য শর্তসাপেক্ষ মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এরপর দফা-দফায় ছয় মাস করে তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ায় সাবেক সরকার। তাকে উন্নত চিকিৎসার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। চিকিৎসকরাও উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশ প্রেরণের সুপারিশ করেন। কিন্তু হাসিনার সরকার সেটি অগ্রাহ্য করে। ২০২৪ সালের আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়। পরদিন ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান বেগম খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য স্বৈরাচারী এরশাদ, হাসিনা ও মইনুদ্দিন, ফখরুদ্দীন সরকার এমন কোনো চক্রান্ত নেই যা করেননি। কিন্তু বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্রপ্রহরী বেগম খালেদা জিয়া টানা ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে আছেন। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি নিখাত ভালবাসা খালেদা জিয়াকে সবচেয়ে আপন জনে পরিণত করেছে। তিনি সশস্ত্র হুমকিতেও দেশ ছেড়ে যাননি শুধু বাংলাদেশের মানুষের পাশে থাকার জন্য। কর্মগুণে, আন্তরিকতায় ও সততায় হয়ে গেছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্মরণকালের কুখ্যাত স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শাসনামলে খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, যে বাড়িতে তার প্রাণপ্রিয় স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া শেষদিন পর্যন্ত জীবনযাপন করেছেন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে শহীদ মইনুল হোসেন সড়কের বাড়িটি কেবল একটি বাড়ি ছিল না, এটি ছিল ইতিহাসের স্মৃতিময় গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। সেই বাড়ি থেকে যখন তাকে এক কাপড়ে বের করে দেওয়া হয়, তখনো খালেদা জিয়া কোনো ধরনের রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে যাননি। এমনকি বাড়ি নিয়ে নজিরবিহীন অপপ্রচারের জবাবও দেননি। খালেদা জিয়া মূলত এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি একজন আদর্শবান মহীয়সী নারী। জাতির অভিভাবকের মতোই তিনি আচরণ করেছেন সব সময়। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর খালেদা জিয়া কারাগার থেকে বেরিয়ে চিকিৎসার জন্য গত জানুয়ারিতে যান লন্ডনে, সেখানে ঈদ করেন তার পুত্রের সঙ্গে। যুক্তরাজ্য থেকে তিনি ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে। সেখানেও তিনি কারো ব্যাপারে বিষোদগার করেননি, কোনো রাজনৈতিক বিভক্তির কথা বলেননি, অনৈক্যের কথা বলেননি, ধ্বংসাত্মক কথাবার্তা বলেননি, উসকানিমূলক বক্তব্য দেননি। ঐক্যের কথাই বলেছেন। এটিই একজন আদর্শ কীর্তিমান রাজনীতিবিদের বৈশিষ্ট্য।
একজন রাজনীতিবিদ যে পরিশীলিত ভাষায় কথা বলে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, তার প্রমাণ বেগম খালেদা জিয়া। এ কারণেই বাংলাদেশের ইতিবাচক রাজনীতিতে এখন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র তিনি। জীবনের ৮০টি বছর পার হলেও এখনো সাধারণ জনগণের মধ্যে এখনো রয়েছে তার বিপুল জনপ্রিয়তা । বিশেষ করে বর্তমান সময় যখন রাজনীতিতে এক পক্ষ অন্য পক্ষের চরিত্র হননের জন্য অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করে, সেই সময় খালেদা জিয়ার মতো সাহসী ও মহীয়সী নারী রাজনীতিবিদ যেন জাতির জন্য এক সূর্যসম আলোকবর্তিকা।
জীবন চলার পথে কীভাবে রাজনীতিবিদদের সাথে কথা বলতে হয়, সমালোচনা করেও কীভাবে পরমতসহিষ্ণুতা দেখানো যায়, সম্মান জানানো যায়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বেগম খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া কখনো প্রতিশোধপ্রবণ রাজনীতিতে বিশ্বাস করেননি। তিনি এক উদার গণতান্ত্রিক চেতনার ধারক ও বাহক। এ কারণেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যেসব অন্যায়-অবিচার করা হয়েছে, সেই অন্যায়-অবিচারগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তিনি দিয়েছেন দেশের জনগণের ওপর। তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে যেসব কথা বলেছেন সবই জনগণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু একটিবারও নিজের কথা বলেননি। তিনি জনগণের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা বলেছেন। নতুন করে বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা বলেছেন। এটি তার ঐতিহাসিক পরিকল্পনা ও মহত্ত্বের নমুনা। রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও বৈশিষ্ট্য একজন রাজনীতিবিদকে পরিণত করে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে। সেটি খালেদা জিয়া প্রমাণ করেছেন।
একজন প্রতিপক্ষের রাজনীতিবিদকে কী ভাষায় কথা বলতে হবে, ভিন্নমতের ব্যাপারে কী ধরনের ভদ্রতা ও শিষ্টাচার দেখাতে হবে, সম্মান দেখাতে হবে, তা আমাদের রাজনীতি থেকে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। এ রকম একটি অসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিবেশে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বেগম খালেদা জিয়া। তিনি এদেশের রাজনীতিতে বিনয়ের প্রতীক হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছেন জনগণের মাঝে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ৬ আগষ্ট তিনি যখন প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থায় মুক্তি পান, এর পর থেকে তার প্রতিটি আচরণ তাকে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন করেছে। দল-মত-নির্বিশেষে সবাই তার দূরদর্শিতা, প্রাজ্ঞ উদারতা, ধৈর্য ও ক্ষমাশীলতায় মুগ্ধ হয়েছেন । নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে সব মানুষের হৃদয় জয় করেছেন তিনি। তার সততা, নিষ্ঠা, পরিমিতিবোধ, আচার-আচরণ এবং সংযতবাক এ দেশের সকল শান্তিকামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তিনি কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন, কিন্তু সেই সমালোচনা কখনো অসভ্যতা, অন্যায় ও শিষ্টাচারবহির্ভূত হয়নি। অশালীন নোংরামির পর্যায়ে যায়নি। তিনি কখনো জাতীয় নেতাদের অসম্মান করে বক্তব্য দেননি। এ ধারাটি তিনি অব্যাহত রেখেছেন সারা জীবনে। রাজনীতিতে নিজের অবস্থান আদর্শ থেকে এতটুকু বিচ্যুত না হয়েও যে একজন রাজনীতিবিদ শিষ্ঠাচার মেনে চলতে পারেন, বিনয়ী ও ভদ্রোচিত ভাষায় তীব্র থেকে তীব্র্রতর সমালোচনা করতে পারেন, সেই ইতিহাস তিনি সৃষ্টি করে গেছেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে সাবেক আওয়ামী লীগের পাতি নেতারাও বেগম জিয়া সম্পর্কে যে কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন, তা প্রকাশ করা তো দূরের কথা, চিন্তা করাও কুরুচির পরিচয় বহন করে। এসব অসভ্য অমার্জনীয় নোংরামির জবাব না দিয়ে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন সকল বিতর্কের উর্ধ্বে। তার প্রতিবাদহীনতাই যেন মানুষের ভালোবাসার মূল উৎস। ফ্যাসিবদী সাবেক সরকারের বিরুদ্ধে তার যেসব কড়া কথা বলা উচিত ছিল, সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ভাষা প্রয়োগ করার কথা ছিল, কিন্তু তার পারিবারিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা তাকে সেই স্বীকৃতি দেয়নি। বরং তিনি তাদের শুধু নীতির সমালোচনা করেছেন, তাদের ভোট চুরির সমালোচনা করেছেন, তাদের অরাজকতা, গুম, হত্যা, খুন, রাহাজানি ও লুণ্ঠনের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু কোনো ব্যক্তিকে অশালীন, কুৎসিত ভাষায় তিনি আক্রমণ করেননি। খালেদা জিয়ার এ ধরনের রাজনৈতিক মহানুভবতা আজকের দিনে ভবিষ্যতে সবার জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে।
গৃহবধূ থেকে সময়ের প্রয়োজনে রাজনীতিতে এসেছেন বেগম খালেদা জিয়া। অথচ রাজনীতির তার চলার পথ মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। রাজনীতির বাঁকে বাঁকে বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তিনি এগিয়েছেন। অর্জন করতে পেরেছেন মানুষের আস্থা। কর্মগুনে তিনি মানুষের ভরসাস্থলে পরিণত হয়েছেন।
আমাদের রাজনীতির আকাশে বেগম খালেদা জিয়া উজ্জ্বলতম নক্ষত্র- লুব্ধক। তার মহাপ্রয়াণে আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটি খসে পড়লো। খালেদা জিয়ার সততা, নিষ্ঠা, মানবতা, ক্ষমা, শান্তি, সৌহার্দ্য, ত্যাগ ও দেশপ্রেমের আদর্শ অনুসরণ করতে পারলে মানবিক বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে।

